রবিবার, ৩ এপ্রিল, ২০১১

রাঙামাটিতে পার্বত্য ভাষা সম্মেলন অনুষ্ঠিত

ভাষার স্বীকৃতি ঘোষণার দাবি


মাতৃভাষা শিক্ষা ও মাতৃভাষায় শিক্ষা গ্রহণসহ নিজ নিজ বর্ণমালায় প্রাইমারি স্কুল পর্যন্ত শিক্ষা গ্রহণের দাবি জানিয়ে রাঙামাটিতে গত ২৬ ফেব্রুয়ারি প্রথম পার্বত্য ভাষা সম্মেলন সমাপ্ত হয়েছে। সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী দীপংকর তালুকদার এমপি বলেছেন, আদিবাসীদের শিক্ষার মাধ্যম কী হবে, তাদের পাঠ্যসূচিতে কী কী বিষয় সংযুক্ত হবে, সবকিছুই নির্ধারণ করবে আদিবাসী জনগণ। সরকারের পরিকল্পনাতেও তা-ই রয়েছে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট-এ আদিবাসীদের ভাষা সংরক্ষণ, বিকাশ, প্রচলন ও গবেষণা করার জন্য একটি স্বতন্ত্র অনুষদ করার পরিকল্পনা সরকারের রয়েছে। এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে আদিবাসী বিষয়ক একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করার প্রয়াস সরকারের রয়েছে। সেভ দ্যা চিলড্রেন, জাবারাং, গ্রাউস ও সাস সহ বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থার যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত সম্মেলনে পার্বত্য অঞ্চলের ভাষা বিশেষজ্ঞ, গবেষক, উন্নয়নকর্মী, সংবাদকর্মী, শিক্ষক, প্রথাগত নেতৃত্ব, ভাষা কমিটিসমূহসহ বিভিন্ন পর্যায়ের প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করেন। বিশিষ্ট গবেষক সুগত চাকমা উদ্বোধনী অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন। এতে বিশেষ অতিথির বক্তৃতা করেন সেভ দ্যা চিলড্রেন প্রতিনিধি ম. হাবিবুর রহমান, দৈনিক প্রথম আলোর রাঙামাটি প্রতিনিধি হরি কিশোর চাকমা, এসআইএল-এর প্রতিনিধি ফিওনা মর্গান প্রমুখ।


জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সদস্য নিরূপা দেওয়ানের সভাপতিত্বে আয়োজিত বিকেলের অধিবেশনে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের সদস্য স্নেহ কুমার চাকমা। বিশেষ অতিথি ছিলেন আঞ্চলিক পরিষদ সদস্য ঊষাতন তালুকদার, প্রাথমিক শিক্ষা অধিপ্তরের উপপরিচালক এ কিউ এম সাইফুল আজম, সহকারী পরিচালক মো. ইমামুল হক ও ভাষা গবেষক ক্য শৈ প্রু খোকা।


প্রধান অতিথির ভাষণে স্নেহ কুমার চাকমা বলেন, বর্তমান সরকার আদিবাসীদের উন্নয়নে নানামুখি কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে চলেছে। আদিবাসীদের মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা চালু করার প্রক্রিয়াও এই কর্মসূচির অন্যতম অংশ। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের মধ্য দিয়েও সরকারের এই কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা সম্ভব বলে তিনি মতব্যক্ত করেন।


বিশেষ অতিথি এ কিউ এম সাইফুল আজম বলেন, সরকার আদিবাসীদের মাতৃভাষায় শিক্ষা গ্রহণের অধিকার বাস্তবায়নে বিশেষ যত্নশীল। তাই জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-সহ বিভিন্ন সরকারি দলিলে আদিবাসীদের মাতৃভাষায় শিক্ষা গ্রহণের অধিকারকে যথাযথভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। তিনি সরকারের কর্মসূচি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় সকল আদিবাসী জনগোষ্ঠির সক্রিয় অংশগ্রহণ কামনা করেন।


আয়োজক সংস্থাসমূহের পক্ষে স্বাগত বক্তব্য দেন সাস-এর নির্বাহী পরিচালক ললিত সি চাকমা, সম্মেলনের উদ্দেশ্য বিবরণ করেন সেভ দ্যা চিলড্রেনের মেহেরুন নাহার স্বপ্না এবং মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন জাবারাং-এর নির্বাহী পরিচালক মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা।


দিনব্যাপী আয়োজিত সম্মেলনে নিম্নোক্ত সুপারিশনামা ঘোষণা আকারে গ্রহণ করা হয়-


১। মাতৃভাষা শিক্ষা ও মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা প্রদানের লক্ষ্যে শিক্ষা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা;
২। যেসব জাতিগোষ্ঠির নিজস্ব বর্ণমালা রয়েছে, তাদেরকে নিজ নিজ বর্ণমালায় পাঠ্যপুস্তক রচনায় সহায়তা করা;
৩। যেসব জাতিগোষ্ঠির নিজস্ব বর্ণমালা নেই, তাদেরকে তাদের ভাষার বানানরীতির সাথে উপযোগি হরফ নির্বাচনের সুযোগ প্রদান করা;
৪। হরফ নির্বাচন, বানানরীতি নির্ধারণসহ ভাষা উন্নয়নের যাবতীয় সিদ্ধান্ত সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠির সম্মতি ও সিদ্ধান্তক্রমে চুড়ান্ত করা;
৫। পার্বত্য জেলা পরিষদ, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কর্তব্যের অংশ হিসেবেই মাতৃভাষায় শিক্ষা প্রচলনের উদ্যোগ গ্রহণ করা;
৬। পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও পার্বত্য জেলা পরিষদগুলোর নেতৃত্বে শিক্ষা বিষয়ক সকল কার্যক্রম সমন্বয়ের ব্যবস্থা করা;
৭। স্থানীয়তার ভিত্তিতে পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নের জন্য স্থানীয় বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি উচ্চমানসম্পন্ন কমিটি গঠণ করা;
৮। পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় জাতীয় পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের সাথে যথাযথ সমন্বয় সাধন করা;
৯। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইন ও অঙ্গীকারগুলো (ইউএনসিআরসি, পিআরএসপি, পিইডিপি-২, জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ ইত্যাদি) যথাযথভাবে বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা;
১০। ভাষা কমিটি বা সংশ্লিষ্ট ভাষার জনগোষ্ঠিকে ভাষা ও সংশ্লিষ্ট ভাষায় শিক্ষা প্রচলন সংক্রান্ত কার্যক্রমের সকল পর্যায়ে সম্পৃক্ততা নিশ্চিত করা;
১১। ভাষা উন্নয়নের অংশ হিসেবে প্রতিটি ভাষায় অভিধান প্রণয়ন ও প্রকাশের ব্যবস্থা গ্রহন করা;
১২। নিজ নিজ ভাষায় পঠন-পাঠনের বিষয়ে শিক্ষক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা;
১৩। শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে নিজ নিজ মাতৃভাষায় লেখা ও পড়ার দক্ষতাকে অন্যতম যোগ্যতা হিসেবে বিবেচনা করা;
১৪। মাতৃভাষায় শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলনের জন্য দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করা;
১৫। মাতৃভাষায় শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলনের সকল পর্যায়ে নারীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা;
১৬। আদিবাসী ভাষানীতি প্রণয়ন করা;
১৭। সংবিধানে বাংলা ভাষার পাশাপাশি আদিবাসীদের ভাষাসমূহের স্বীকৃতি প্রদান করা;
১৮। আদিবাসী ভাষা ও শিক্ষা বিষয়ক একটি স্বতন্ত্র কমিশন বা কমিটি গঠন করা;
১৯। প্রতিনিয়ত গবেষণার জন্য সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা নিশ্চিত করা;
২০। আদিবাসী বিষয়ক স্বতন্ত্র একটি মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করা;
২১। জাতীয় পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের ভিতরে আদিবাসী ভাষা বিষয়ক একটি সেল গঠন করা;
২২। ভাষা একাডেমী প্রতিষ্ঠা করে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠির সাংস্কৃতিক ইনস্টিটউটগুলোর সাথে সংযোগ তৈরি করা;
২৩। জাতীয় শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ক্ষেত্রে আদিবাসীদের জন্য শিথিল করা;
২৪। ভাষা প্রমিতকরণ, হরফ উন্নয়ন ও নিজস্ব ব্যাকরণ রীতি প্রণয়ন করা;
২৫। ভাষাকে তথ্যপ্রযুক্তির সাথে সম্পৃক্ত করা; যেমন- ডিজিটাল অভিধান প্রণয়ন ইত্যাদি;
২৬। পাঠ্যসূচি প্রণয়নে মাল্টিমিডিয়া প্রযুক্তির ব্যবহার করা।
তথ্যসূত্র: দৈনিক অরণ্যবার্তা

1 টি মন্তব্য: